বিদেশী খেলাধুলার ভীড়ে আমরা নিজেদের সেই ঐতিহ্যবাহী খেলধুলা গুলোকে হারাতে বসেছি চলুন দেখে নেই বাংলাদেশর প্রাচীন সব খেলধুলা গুলো।
১. ইচিং বিচিং
সাধারণত এই খেলার জন্য শিশু ও কিশোরীরা গ্রাম সংলগ্ন সবুজ মাঠকে নির্বাচন করে। উচ্চতা অতিক্রম এই খেলার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
এই খেলার সাথে সাথে ছেলে মেয়েদের মুখি উচ্চারিত হয়ঃ
"ইচিং বিচিং চিচিং চা
প্রজাপতি উড়ে যা"
খেলার নিয়মাবলীঃ
দু'জন খেলোয়াড় পাশাপাশি বসে খেলোয়াড়দের অতিক্রম করার জন্য উচ্চতা
নির্মাণ করে দেয়। প্রথমে তারা দু'পায়ের গোড়ালি দিয়ে উচ্চতা নির্মাণ
করে। খেলোয়াড়রা উচ্চতা অতিক্রম করার পর তারা পায়ের উপর আরেক পা তু্লে
দিয়ে উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। এইভাবে পায়ের উপর প্রসারিত করতল স্থাপন করে
উচ্চতা বাড়িয়ে তোলা হয়। উচ্চতা অতিক্রম করার পর বসে থাকা খেলোয়াড়রা
দুই পা মুক্ত করে ত্রিকোণাকার একটি সীমানা তৈরি করে। এই পায়ে ঘেরা স্থানটি
পা তুলে দম দিতে দিতে বা ছড়া আওড়াতে আওড়াতে তিনবার অতিক্রম করে লাফ
দিয়ে পার হতে হয়। এই সীমানা অতিক্রম করার পর বসে থাকা খেলোয়াড়দের যুক্ত
পাকে প্রতিটি খেলোয়াড় শূন্যে লাফিয়ে ইচিং বিচিং ছড়া বলতে বলতে দুইবার
করে অতিক্রম করে নেয়। এটিই খেলার শেষ পর্ব।
২. ওপেন টু বাইষ্কোপঃ
গ্রামীন খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম । এর সরলতার কারণে মেয়েদের কাছে ওপেন টু বাইষ্কোপ খেলাটি আজ পর্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে । এটি একটি সহায়ক খেলা । গল গঠন করার জন্য এই খেলাটি খেলা হয় । এই খেলাটির সাএথ জড়িত ব্রিট্রিশ যুগের ইংরেজ সাহেবদের বিনোদনের প্রতি ইঙ্গিত করে ।
এই খেলার সাথে সাথে ছেলে মেয়েদের মুখি উচ্চারিত হয়ঃ
" ওপেন টু বাইষ্কোপ
নাইন টেন তেইশ কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠাকখানা
সাবেহ বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে পানের আগায় মরিচ বাটা
স্প্রিংএর চাবি আঁটা
যার নাম মনিমালা
তাকে দেবো মুক্তার মালা ।"
খেলার নিয়ামাবলীঃ
দু'জন দলপতি ফুল অথবা ফলের নামে নিজেদের দলের নাম নির্বাচন করে। তারা
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু'হাত দিয়ে একটি তোরণ নির্মাণ করে। খেলায়
অংশগ্রহনকারী খেলোয়াড়রা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে রেলগাড়ির মতো
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছড়া বলতে বলতে এই তোরণের নীচ দিয়ে যাতায়াত করতে
থাকে। ছড়া শেষ হবার মূহুর্তে যে খেলোয়াড় তোড়নের মধ্যে অবস্থান করে তাকে
দলপতিরা হাতের মধ্যে বন্দী করে। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করে সে কোন দলে যোগ
দেবে। তখন সে তার পছন্দের দলে যোগ দেয়। এই ভাবে প্রতিটি খেলোয়াড় দুই দলে
বিভক্ত হয়ে মূল খেলা শুরু করে। কখনো কখনো মূল খেলা হিসেবেই ওপেন টু
বাইস্কোপ খেলাটি খেলা হয়ে থাকে।
৩. কড়ি খেলাঃ
এটি আরেকটি বাংলাদেশের গ্রামীন খেলা । যে সব কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত সাধারণত তারাই কড়ি বেশী খেলে থাকে। কড়ি পাঁচ গুটির মতই সমান জনপ্রিয় একিট খেলা । কড়ি হিসাবে খেজুরের বিটি দিয়ে কড়ি বানিয়ে গ্রামে খেলা হয়ে থাকে ।
এই খেলার সাথে সাথে ছেলে মেয়েদের মুখি উচ্চারিত হয়ঃ
"খুশুর খুশুর দুর্গা মাসুর
তিল তালিয়া মার কেলিয়া কুমড়ার চাক ধাপ্পা দিয়া
হাতের কড়ি হাতে থাক"
খেলার নিয়ামাবলীঃ
কড়ি খুবই সহজ ও সরল একটি খেলা। চারটি কড়ি কোনো মসৃণ স্থানে হাত থেকে
গড়িয়ে দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় টোকা দিয়ে আঘাত করে পয়েন্ট সংগ্রহ করা
হয়। আঘাত করতে ব্যর্থ হলে বা কড়ি চালার পর এক সাথে লেগে থাকলে ঐ
খেলোয়াড়ের দান নষ্ট হয়ে যায় এবং অন্য জন খেলা শুরু করে। নিজের মাথার
চুল দিয়ে গ্রামের মেয়েরা প্রায়ই আপাত স্পর্শ করে থাকা গুটিকে পৃথক
প্রমাণ করে থাকে। কড়ি চালার পর যদি তিনটি গুটির বুক উপড়ে থাকে তবে ঐ দান
নষ্ট হয় আর যদি চারটি গুটিই বুক উপড়ে থাকা অবস্থায় পড়ে তবে প্রতি গুটির
জন্য চারটি করে পয়েন্ট পাওয়া যায় এবং এই গুটি সংগ্রহ করা নিয়ে
খেলোয়াড়দের মাঝে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
৪. কানামাছিঃ
গ্রমীণ খেলাধুলার মধ্যে কানামাছি একটি চমৱকার খেলা । এদেশের সর্বত্র শিশু কিশোররা এ খেলা খেলে থাকে ।
এই খেলার সাথে সাথে ছেলে মেয়েদের মুখি উচ্চারিত হয়ঃ
"কানামাছি ভোঁ ভোঁ
যারে পাবি তারে ছো"
খেলার নিয়ামাবলীঃ
এ খেলায় কাপড় দিয়ে একজনের চোখ বেঁধে দেয়া হয়, সে অন্য বন্ধুদের ধরতে চেষ্টা করে । যার চোখ বাঁধা হয় সে হয় 'কানা' । অন্যরা 'মাছি'র মতো তার চারদিক ঘিরে কানামাছি ছড়া বলতে বলতে তার গায়ে টোকা দেয় । চোখ বাঁধা অবস্থায় সে অন্যদের ধরার চেষ্টা করে । সে যদি কাউকে ধরতে পারে এবং বলতে পারে তার নাম তবে ধৃত ব্যক্তিকে কানামাছি সাজতে হয় ।
৫. বাডুডু বা কাবাডিঃ
বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। বর্তমানে কাবাডি আন্তর্জাতিক ভাবেও খেলা হয়। এই খেলা সাধারণত কিশোর থেকে
শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সব ধরনের ছেলেরা খেলে থাকে। সাধারণত বিশেষ উৎসব বা
পালা-পার্বনে বেশ আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে হা-ডু-ডু খেলার আয়োজন করা হয়। কাবাডি
বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে কাবাডি
ফেডারেশন গঠিত হয়েছে। পূর্বে কেবল মাত্র গ্রামে এই কাবাডি খেলার প্রচলন
দেখা গেলেও বর্তমানে সব জায়গায় কাবাডি খেলা প্রচলিত হয়েছে।
খেলার নিয়মাবলীঃ
- মাঠঃ কাবাডি খেলার বালকদের মাঠ লম্বায় ১২.৫০ মিটার চওড়ায় ১০ মিটার হয়। এবং বালিকাদের কাবাডি খেলার মাঠ লম্বায় ১১ মিটার এবং চওড়ায় ৮ মিটার হয়। খেলার মাঠের ঠিক মাঝখানে একটি লাইন টানা থাকে যাকে মধ্যরেখা বা চড়াই লাইন বলে। এই মধ্য রেখার দুই দিকে দুই অর্ধে দুটি লাইন টানা হয় যাকে কোল লাইন বলে। মৃত বা আউট খেলোয়াড়দের জন্য মাঠের দুই পাশে ১ মিটার দূরে দুটি লাইন থাকে যাকে লবি বলা হয়।
- সদস্যঃ প্রতি দলে ১২ জন খেলোয়াড় অংশ নেয়। কিন্তু প্রতি দলের ৭ জন খেলোয়াড় একসাথে মাঠে নামে। বাকি ৫ জন অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে থাকে। খেলা চলাকালীন সর্বাধিক তিন জন খেলোয়াড় পরিব্রর্তন করা যাবে।
- সময়ঃ ৫ মিনিট বিরতি সহ দুই অর্ধে পুরুষদের ২৫ মিনিট করে এবং মেয়েদের ২০ মিনিট করে খেলা হবে। খেলা শেষে যেই দল বেশী পয়েন্ট পাবে সাই দলই জয়ী হবে। দুদলের পয়েন্ট সমান হলে দুঅর্ধে আরও ৫ মিনিট করে খেলা হবে। এরপরেও যদি পয়েন্ট সমান থাকে তবে যে দল প্রথম পয়েন্ট অর্জন করেছিল সে দলই জয়ী হবে।
- পয়েন্টঃ যদি কোন খেলোয়াড় মাঠের বাহিরে চলে যায় তাহলে সে আউট হবে। এভাবে একটি দলের সবাই আউট হলে বিপক্ষ দল একটি লোনা(অতিরিক্ত ২ পয়েন্ট) পাবে। মধ্যরেখা থেকে দম নিয়ে বিপক্ষ দলের কোন খেলোয়াড়কে(একাধিক হতে পারে)স্পর্শ করে এক নিঃশাসে নিরাপদে নিজেদের কোর্টে ফিরে আসতে পারলে, যাদের কে স্পর্শ করবে সে বা তারা কয় জনই আউট হবে। এভাবে যতজন আউট হবে তাদের প্রত্যেকের জন্য এক পয়েন্ট পাওয়া যাবে।
- সতর্কতাঃ এক নিঃশাসে স্পষ্ট ভাবে পুণঃপুণঃ কাবাডি বলে ডাক দেওয়াকে "দম নেওয়া" বলে। এই দম মধ্যরেখা থেকে শুরু করতে হবে।বিপক্ষ কোর্টে একসাথে একাধিক আক্রমণকারী যেতে পারবে না। কোন আক্রমণকারী বিপক্ষ দলের কোর্টে দম হারালে এবং বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় তাকে স্পর্শ করতে পারলে সে আক্রমণকারী আউট বলে গণ্য হবে।